সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়ার ইতিহাস
এ কে এম মহিউদ্দিন:
আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামী ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে গঠিত এক আধুনিক ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা, যা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরুর পরে উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতি বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ১৭৮০ সালে বাংলার ফোর্ট উইলিয়ামের গর্ভনর ওয়ারেন হেস্টিসং কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটান। পরবর্তী সময়ে এই কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আদলে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মূলত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকেই আলিয়া মাদ্রাসা বলা হয়।
আলিয়া মাদ্রাসায় কুরআন, হাদিস, বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজিসহ সকল সাধারণ বিষয় পড়ানো হয়। এইজন্য আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী আলিয়া মাদ্রাসায় ইবতেদায়ী বা প্রাথমিক শিক্ষায় ৫ বছর, দাখিল বা মাধ্যমিক শিক্ষায় ৫ বছর, আলিম বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় দুই বছর, ফাজিল বা স্নাতক শিক্ষায় দুই বছর এবং কামিল বা স্নাতকোত্তর শিক্ষায় দুই বছর ব্যয় করতে হয়। সবমিলিয়ে ইবতেদায়ী থেকে কামিল পর্যন্ত মোট ১৬ বছরের কোর্সে পরিচালিত হয় বর্তমানে বাংলাদেশের আলিয়া মাদ্রাসার ইবতেদায়ী, দাখিল ও আলিম স্তর বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং ফাজিল ও কামিল স্তর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রয়েছে।
ইতিহাস_সম্পাদনা
১৭৮০ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা, ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এছাড়া অনন্য শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে ১৮৫৭ সালে ইংরেজি শিক্ষার ধারায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৮৬৬ সালে কওমি শিক্ষা ধারায় দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। এজন্য গোটা ভারতবর্ষে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বপ্রাচীন বলা হয়।
১৭৮০-১৯১৪ সম্পাদনা
১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হলে, পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসার সিলেবাস ও শিক্ষা সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময় কমিটি গঠন করা হয়। ১৭৯১ সালে কলকাতা মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদ প্রথমবারের মত শিক্ষা কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রবর্তন করে। এ সিলেবাস কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় বাস্তবায়ন করা হয় এবং এই মাদ্রাসার অধিভুক্ত বাংলা, আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চলের সকল মাদ্রাসায়ও বাস্তবায়ন করা হয়। এরপর ১৮৬৯ সালে নতুন কমিটি গঠন করে আবারো পাঠ্যসূচিতে কিছুটা সংশোধনী আনা হয়। ১৮৭১ সালে বিচারপতি নরম্যান কমিটি বেঙ্গল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন সাধন করে। কলকাতা মাদ্রাসার এই শিক্ষা ব্যবস্থা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে দিতে ১৮৭৩ সালে মহসিন ট্রাস্টের অর্থে ঢাকা মাদ্রাসা (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা ও ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা), চট্টগ্রাম মাদ্রাসা (বর্তমানে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম) ও রাজশাহী মাদ্রাসা (বর্তমানে হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী) নামে তিনটি সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
১৮৮২ সালের হান্টার কমিটির রিপোর্টের ৩৬টি সুপারিশ ১৮৮৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হলে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে গতিশীলতা আসে। ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের কলকাতা কনফারেন্সে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসাকে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) সমমানের তিন বছরের টাইটেল ক্লাস খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯১০ সালে অধ্যক্ষ এ এইচ হার্লের নেতৃত্বে গঠিত মোহমেডান এডুকেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আরো কিছু সংস্কার সাধন করে।
১৯১৪-১৯৪৭ সম্পাদনা
১৯১৪ সালে শামসুল উলামা আবু নসর ওহীদ নেতৃত্বের গঠিত মোহমেডান এডুকেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি কর্তৃক প্রণীত কারিকুলামে ওল্ড স্কিম ও নিউ স্কিম মাদ্রাসা ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয় এবং ১৯১৫ সালে তা বাস্তবায়িত হয়। মূলত মুসলমানদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার জন্য জুনিয়র ও সিনিয়র নামে দু’ধরনের নিউ স্কিম মাদ্রাসা চালু করা হয়। তৎকালীন সময়ে জুনিয়র মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আর সিনিয়র মাদ্রাসায় ১০ম মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হতো। এসকল সিনিয়র মাদ্রাসার পাঠক্রমে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে সরকারি অনুদানভুক্ত করা হয়। সেই সময়ে সরকারি চাকরি পেতে মুসলিম শিক্ষার্থীরাও ইংরেজি শিখতে আগ্রহী ছিলো, এইজন্য তারা নিউ স্কিম মাদ্রাসায় পড়া পছন্দ করেছিলো। সেই সময়ে নিউ স্কিম শিক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো।
শামসুল হুদা কমিটি ১৯২৭ সালে বাংলা ও আসামের ওল্ড স্কিম সিনিয়র মাদ্রাসাগুলোর আলিম, ফাজিল ও ফখরুল মুহাদ্দিসীন শ্রেণীর পরীক্ষাসমূহ কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজন করার পরামর্শ দেয় এবং এই কেন্দ্রীয় পরীক্ষা আয়োজন করার জন্য একটি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড গঠন করার প্রস্তাব তোলে। এই কমিটির পরামর্শে কামিলের সিলেবাসে সিহাহ সিত্তাহ (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, আবু দাউদ), উসুলুল হাদিস, তাফসীরুল বায়যাবী, তাফসীরুল কাশশাফ, তাফসীরুল কবীর, তাফসীরুল মাজমুউল বয়ান, ফিকহ, উসুলুল ফিকহ, মানতিক, ইসলামের ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯২৭ সালে মোহমেডান এডুকেশনের এক সদস্য ও খাজা কামাল উদ্দীন আহমদের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড, বাঙলা নামে সর্বপ্রথম একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন হয়। কলকাতা মাদ্রাসা ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সরকারি সংস্থা হিসেবে এই শিক্ষাবোর্ডের সাথে সংযুক্ত ছিলো।
১৯৩১ সালের মুসলিম এডুকেশন এডভাইজরি কমিটি বা মোমেন কমিটি ও ১৯৩৮-৪০ সালের মাওলা বখশ কমিটি আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের সুপারিশ করে। এছাড়াও ১৯৪৬ সালে সৈয়দ মোয়াজ্জমউদ্দিন হোসাইন কমিটি শিক্ষার সংস্কার ও উন্নয়নে যে সুপারিশ করে, এই প্রস্তাব পূর্ণভাবে গ্রহণ করা হয়। এর ফলে সিলেবাসের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৪৭-১৯৭১ (আধুনিক কাল)সম্পাদনা
ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা
১৯৪৭ সালের বহু পূর্বেই কলকাতা মাদ্রাসার আদলে পূর্ব বাংলাতে বহু আলিয়া মাদ্রাসা গড়ে উঠে। এসব মাদ্রাসার মধ্যে নোয়াখালী কারামতিয়া মাদ্রাসা (১৮৫০), পাইকান মাদরাসা (১৮৬০), সুজাউল মাদ্রাসা (১৯৮০), মিঠাছড়া মাদ্রাসা (১৮৮১), সীতাকুণ্ড মাদ্রাসা (১৮৮৬), রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসা (১৮৮৬), ফরিদগঞ্জ মাদ্রাসা (১৮৯৬), সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা (১৯১৩), ছারছিনা মাদ্রাসা (১৯১৫) প্রভৃতি অন্যতম। এছাড়াও ১৯৪৭ সালের পূর্বে সরকার অনুমোদিত ও শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক অনুমতিপ্রাপ্ত বহু মাদ্রাসা বাংলাদেশে উপস্থিত ছিলো। ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণে আলিয়া মাদ্রাসার আইডল কলকাতা মাদ্রাসার একাংশ ঢাকাতে স্থানান্তর করা হয়। তবে সেই সময় ঢাকা আলিয়াসহ বাংলাদেশের সকল আলিয়া মাদ্রাসার বোর্ড পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতো।
আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা সংস্কারের জন্য ১৯৪৯-৫১ সালে মোহাম্মদ আকরম খাঁর পূর্ববাঙলা শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি, ১৯৫৬ সালে আশরাফউদ্দীন চৌধুরী কমিটি, ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান শিক্ষা সংস্কার কমিশন, ১৯৫৮ সালে এম এম শরীফ জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৬৩ সালে এস এম হোসাইনের ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি, ১৯৬৯ সালে ইমামুদ্দীন চৌধুরীর মাদ্রাসা পর্যালোচনা কমিটি, ১৯৭২-৭৩ সালে কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রভৃতি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭৩ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার সংস্থা নামক সংগঠন মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন সুপারিশ করে। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে আলিয়া মাদ্রাসা সমূহ ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়, এবং পরবর্তীতে সময়ে ১৯৭৮ সালে মাদ্রাসার জন্য আলাদা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হলে মাদ্রাসাসমূহ এই বোর্ডে স্থানান্তরিত হয়।
কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৭৫ সালে মাদ্রাসা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসাসমূহে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও বহুমুখী পাঠ্যসূচি প্রবর্তিত করা হয়। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত আলিম ও ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত ফাজিল পরীক্ষার সিলেবাসে পরিবর্তন আনা হয়। এই শিক্ষা কমিশন অনুসারে ফাজিল ও আলিম শ্রেণীতে সাধারণ পাঠ্যসূচী অন্তর্ভুক্ত করে ফাজিল পরীক্ষাকে সাধারণ শিক্ষা এইচ এস সির সমমান ও আলিম পরীক্ষাকে সাধারণ শিক্ষা এস এস সির সমমান প্রদান করা হয়। এই কমিশনই মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান শাখা চালু করে।
১৯৭৮ সালে অধ্যাপক মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিনিয়র মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির নির্দেশনায় ১৯৮৪ সালে সাধারণ শিক্ষার স্তরের সঙ্গে বাংলাদেশ মাদ্রাসা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা স্তরের সামঞ্জস্য করা হয়। আলিয়া মাদ্রাসার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) ৫ বছর, দাখিল স্তর (মাধ্যমিক) ৫ বছর, আলিম স্তর (উচ্চ মাধ্যমিক) ২ বছর, ফাযিল স্তর (ডিগ্রি) ২ বছর এবং কামিল স্তর (স্নাতকোত্তর) ২ বছর, মোট ১৬ বছর ব্যাপী পূর্ণাঙ্গ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। পাঠ্যসূচী পরিবর্তন করে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এর অধিনে দাখিল পরীক্ষাকে এস.এস.সি এবং আলিম পরীক্ষাকে এইচ এস সির সমমান দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে ইসলামি আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে ফাজিল(ডিগ্রী) ৩ বছর (অনার্স) ৪ বছর এবং মাস্টার্স ১ বছর পড়ানো হয়।
কলকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইন্স সহ
সকল সাব্জেক্ট এর অনার্স, মাস্টার্স ও
পিএইচডি চলমান রয়েছে!
লেখক – একেএম মহিউদ্দিন
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া