
ফরিদপুর থেকে প্যারিস, ইতিহাসের ছায়ায় এক শিল্পযাত্রা “নাফিজ ইসলাম”।
নিজস্ব প্রতিবেদন:
বাংলাদেশের জন্য এক গর্বের মুহূর্ত। ফরিদপুর শহরের সাধারণ এক ছেলেকে আজ চিনছে বিশ্ব শিল্প ও ইতিহাসের অনন্য সংরক্ষণাগার প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশি আলোকচিত্রী নাফিজ ইসলামের অনবদ্য আলোকচিত্র সিরিজ ‘Shadows of History’।
এই অর্জন কেবল একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণ নয় এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভূচিত্রে এক উজ্জ্বল চিহ্ন, যা ইতিহাস, মানবিকতা ও শিল্পের গভীর এক মেলবন্ধন ঘটায়।
ছবির মাঝে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি
নাফিজ ইসলামের ‘Shadows of History’ কেবল আলোকচিত্র সিরিজ নয়, এটি সময়ের দলিল, জীবনের ক্যানভাসে আঁকা মানুষের সংগ্রাম ও করুণার প্রতিচ্ছবি।
বিশ্ববিখ্যাত লুভর মিউজিয়ামের আধুনিক ফটোগ্রাফি বিভাগ এই সিরিজ থেকে দুটি আলোকচিত্র সংগ্রহ করেছে। তার মধ্যে একটি চিত্রে দেখা যায় একজন বৃদ্ধ লোক গরুকে জলাশয় থেকে টেনে তুলছেন। দৃশ্যটি যেমন সরল, তেমনি শক্তিশালী। এটি বাংলার গ্রামের বাস্তবতা, মমতা ও মানবিক টানাপোড়েনের নিখুঁত প্রতীক।
এই দৃশ্য শুধু একটি গ্রামীণ মুহূর্ত নয়—বরং সময়, শ্রম ও সম্পর্কের এক জীবন্ত অনুবাদ।
শৈশবের ফরিদপুর থেকে আন্তর্জাতিক গ্যালারির আলোকমঞ্চে
নাফিজ ইসলামের শৈল্পিক যাত্রা শুরু ফরিদপুর শহরের কাদামাটি থেকে। ছোটবেলায় মঞ্চ নাটকের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা তাঁকে যুক্ত করে নাট্যগুরু মুন্সী মুহাম্মদ আলী রুমির সঙ্গে। তাঁর হাত ধরে যোগ দেন ‘বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী’-তে, যেখান থেকে শুরু হয় মঞ্চের প্রতি তাঁর নিবেদন।
পরবর্তী সময়ে কয়েকজন সৃজনশীল তরুণকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বিনোদন নাট্যদল ফরিদপুর’, যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন নাফিজ।
তাঁর এই নাট্যমুখী যাত্রার সঙ্গেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় আলোকচিত্রের প্রতি ভালোবাসা। মঞ্চের আবেগ আর মানুষের জীবনের সূক্ষ্ম রংগুলি তাঁর ক্যামেরায় প্রতিফলিত হতে থাকে।
পেশাগত পথচলা ও ‘শতফুল আলোকচিত্র’ প্রতিষ্ঠা
২০১৮ সালে ঢাকায় তিনি ফটো জার্নালিস্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দেশের এক শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় কাজের পাশাপাশি ফটোগ্রাফার হিসেবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে।
নিজস্ব প্রতিষ্ঠান “শতফুল আলোকচিত্র” গড়ে তোলেন, যার মাধ্যমে তিনি সংরক্ষণ করেন হাজারো মুহূর্ত—যা শুধুই দৃশ্য নয়, সময়ের সাক্ষ্য হয়ে ওঠে।
লুভরের স্বীকৃতি: শিল্পের শিখরে এক বাংলাদেশি
লুভর মিউজিয়ামের সংগ্রহে যখন একটি আলোকচিত্র স্থান পায়, তা বিশ্ব শিল্প জগতের সর্বোচ্চ স্বীকৃতির সমতুল্য।
নাফিজ ইসলামের কাজকে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ জন্যই যে, তাঁর লেন্সে ধরা পড়ে মানুষ—তার শ্রম, আবেগ, সংকট ও সৌন্দর্য।
নাফিজ বলেন,
“ছবির মতো বাস্তব ও মানবিক মুহূর্তগুলোও ঠিক তেমনভাবে সংরক্ষিত হওয়া উচিত, যেমনটি লুভর মিউজিয়ামে শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শিত হয়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম ও সৌন্দর্যকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়াটাই আমার কাজ।”
একজন আলোকচিত্রীর স্বপ্ন ও দায়িত্ব
নাফিজ ইসলামের এই অর্জন প্রমাণ করে যে সৎ দৃষ্টিভঙ্গি, গভীর পর্যবেক্ষণ এবং মানবিক চিন্তাভাবনা থাকলে একজন শিল্পীর লেন্সও ইতিহাস লিখতে পারে।
আজ তিনি শুধু একজন সফল শিল্পী নন, বিশ্বব্যাপী আলোকচিত্র শিল্পীদের জন্য এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর এই পথচলা ভবিষ্যতের প্রজন্মকে প্রেরণা দেবে—বিশ্বাস করতে, যে কোনো ছোট শহর থেকেও ছোঁয়া যায় বিশ্বের বৃহত্তম মঞ্চ।
‘Shadows of History’—এটি শুধুই একটি আলোকচিত্র সিরিজ নয়। এটি ইতিহাসের ছায়ায় গড়া এক শিল্পী, এক জাতি এবং এক সময়ের আত্মকথা।