সবার কথা বলে

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন রেকর্ডিং এর ইতিহাস

0 361
সৈয়দপুরে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন রেকর্ডিং এর ইতিহাস।
মাসুদুর রহমান – নীলফামারী:
নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরে নতুন বাবু পাড়ায় বসবাসকারী শহীদ আমিনুল হক ছিলেন শহীদ ডা. জিকরুল হকের ছোট ভাই। বঙ্গবন্ধু ভাষন দেবেন। এবং সেই ভাষনে  পরবর্তি করনীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা থাকতে পারে। আর সেটি উপলব্ধি করতে পেরে সেটি রেকর্ড করার জন্য চিন্তা ভাবনা করল। তৎকালীন সময়ে ঢাকার ভাষন সৈয়দপুরে বসে  জোগাড় করা এত সহজ ছিল না। তাহলে এত দ্রুত কিভাবে জোগাড় হল জনগনের কাছে কিভাবে পৌছাবে এক্ষেত্রে মূখ্য ভুমিকা পালন করে ডাঃ জিকরুল হকের  ভাই সাবেক কমিশনার,সৈয়দপুর আওয়ামীলীগের প্রতিষ্টাতা সদস্য, তৎকালীন আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ আমিনুল হক, গোলো ভাই নামে পরিচিত এক মহান মানুষ।
শহীদ আমিনুল হকের বড় মেয়ের নাম ছিল আফলা। উনার স্বামী কৃষিবিদ আমজাদ হোসেন তুরস্ক থাকাকালীন সেখান থেকে রেডি ক্রয় করেন। এই রেডিও গুন ছিল রেকর্ডিং করা যেত। তুরস্ক থেকে আনা রেকর্ডিং রেডিও আমজাদ হোসেনের কাছে থেকে সংগ্রহ করেন আমিনুল হক। বর্তমান শহীদ ডা: জিকরুল হক রোডে তৎকালীন ডাক্তার জিকরুল হকের চেম্বার থেকে আওয়ামীলীগের অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা হত। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কিভাবে এই ভাষন জনগনের কাছে পৌছানো যায়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাষন প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
শহীদ আমিনুল হকের উপস্হিত বুদ্ধিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষন বেতার থেকে রেকর্ড করে।রেকর্ড করার সময় বিদ্যুৎ ছিল না। ব্যাটারী ব্যবহার করা হয়। এ কাজে সহযোগীতা করে তার   ভাতিজা শহীদ কুদরত। শহীদ কুদরত ছিল সৈয়দপুরের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী ছাত্র। পরবর্তীতে পতাকা বানানো দর্জি ও কুদরত এলাহীকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।
এভাবেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি রেকর্ড করে শহীদ আমিনুল হক বাজানো শুরু করে। শহীদ আমিনুল হক (গোলো) রেকডিং ভাষন প্রচার করে বাজিয়ে জনগনকে সে সময় ঐক্যবদ্ধ করেন। গ্রামের হাটে বাজারে ভাষন বাজানোর ব্যবস্হা করেন। ভাষন শুনে মানুষ যুদ্ধের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে লাগল। এর কারণেই শহীদ আমিনুল হককে খান সেনাদের সহযোগিতায় নির্মমভাবে ভাবে হত্যা করে সৈয়দপুরের বিহারী রাজাকাররা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিনা পারিশ্রমিকে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে অনেক বাঙালিকে ধরে আনে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা। শহীদ আমিনুল হককে ২৮ মার্চ তাঁর নতুন বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। সৈয়দপুর হাইস্কুলের একটি কক্ষে অনেকের সঙ্গে তাঁকেও আটকে রেখে নির্মাণকাজ করতে বাধ্য করে। এ ধরনের কাজে অনভ্যস্ত বলে ক্লান্ত হয়ে পড়লে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হতো তাঁকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষন প্রচার মুক্তিবাহীনিকে একত্রিত করার অজুহাতে নির্মমভাবে অত্যাচার করতো তাকে।
এক পর্যায়ে, ২৮ জুন পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করার জন্য,  অপারেশন খরচাখাতার নামে স্হানীয় অবাঙ্গালিদের হাতে তুলে দেন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেরার পথে শহীদ তুলশিরাম সড়কের বর্তমান সিঙ্গারের অফিসের সামনে থেকে শহীদ আমিনুল হককে বস্তায় বন্দি করা হয়।  বস্তায় বন্দি করে পৌরসভা ভবনের সামনে ভুলিয়া মারয়ারীর গোডাউনে নেওয়া হয়। একজন উপস্হিত অবাঙ্গালী নির্যাতন ও হত্যার নির্মমতা স্বচক্ষে দেখে পরিবারের কাছে বর্ননা করেন।এছাড়া দেবু প্রসাদ নামে একজন মুচিও স্বাক্ষী রয়েছেন।
সেখানে প্রচুর অত্যাচার চালায় .আমিনুল হকের প্রথমে চোখ উপড়ে ফেলে  নরঘাতকেরা। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি আর্তনাদ করতে থাকলে পিশাচের দল আরও উল্লসিত হয়ে ওঠে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর হাতের আঙুল, হাত-পা কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়। এখানেই শেষ নয়, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমিনুল হকের শরীরের খণ্ডিত অংশগুলো পাটকলের ‘জুটপ্রেস’ নামের যন্ত্র দিয়ে পিষে ফেলে তারা। এভাবেই নির্মম অত্যাচার করে শহীদ আমিনুল হককে হত্যা করা হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালিকে একত্রিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী এই ভাষণটি শুনিয়ে গ্রামে গঞ্জে হাটে বাজারে বাঙ্গালীদের হৃদয়ে জাগ্রত করেছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুগত এই শহীদ আমিনুল হকের জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর বাবা জেয়ারতউল্লাহ আহমদ। সৈয়দপুর কায়েদে আযম কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছিলেন। বড় ভাই জিকরুল হক ছিলেন সৈয়দপুরের খ্যাতিমান চিকিৎসক।১৯৫৪, ১৯৭০ সালের এমপি, সৈয়দপুর পৌরসভার ১৯৫৮ সালের প্রতিষ্টাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।  পেশাগতভাবে তিনি বড় ভাইয়ের ডিসপেনসারিতে চিকিৎসা সহকারী হিসেবেও কাজ করতেন।শহীদ আমিনুল হক ১৯৫৮ সালের সৈয়দপুর পৌরসভার গেজেটে তালিকার ২ নং সিরিয়ালে একজন প্রতিষ্টাতা সদস্য ও কমিশনার ছিলেন।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ আমিনুল হকের তিন ভাই, ১ জন ভাতিজা, পরিবারের সাতজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।স্বাধীনতার পর শহীদ আমিনুল হকের নামে সৈয়দপুর শহরের একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়া শহরের ইসলামবাগ এলাকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও তাঁর নামে হয়েছে। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শহীদ আমিনুল হকের সন্তান হিসেবে মো: মহসিনুল হক মহসিনকে সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করেন।

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.